অ্যাকাউন্টে লগইনের জন্য সাধারণত পাসওয়ার্ড শব্দটিরই ব্যবহার হয় বেশি। বলা হয় শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা। কিন্তু ডিজিটাল পরিসরে পাসওয়ার্ড এখন যেন একটু সেকেলে হয়ে পড়েছে। হ্যাকাররা এতো আধুনিক সব পদ্ধতি গড়ে তুলেছে, যেগুলো দিয়ে সচরাচর তৈরি করা ৮-১৪ ওয়ার্ডের নানা ধরনের পাসওয়ার্ড সহজেই ভেঙে ফেলা যাচ্ছে। ফলে অনলাইন অ্যাকাউন্টের সুরক্ষায় এখন আর পাসওয়ার্ড যথেষ্ট হচ্ছে না। প্রয়োজন হয়ে পড়েছে পাসফ্রেজ-এর।

২০২১ সালে হ্যাকারদের একটি ফোরামে  ফাঁস করা হয় হ্যাকিংয়ের শিকার ৮৪৫ কোটি পাসওয়ার্ডের একটি তালিকা। এটিসহ অন্যান্য আরও অনেক পাসওয়ার্ড এরই মধ্যে জেনে যাওয়ায় হ্যাকারদের কম্পিউটার প্রোগ্রাম ও অ্যালগরিদমগুলো সহজেই অনুমান করতে পারে: মানুষ কিভাবে, কোন প্যাটার্নে পাসওয়ার্ড তৈরি করে, এবং দ্রুত সেসব পাসওয়ার্ড অনুমানও করে ফেলতে পারে। ব্যবহৃত পাসওয়ার্ডের ডেটাবেজ যতো ভারী হতে থাকবে— ততই বাড়তে থাকবে হ্যাকারদের সাফল্যের সম্ভাবনা। ফলে আপনাকেও চিন্তা করতে হবে নতুন নতুন উপায়ে অনলাইন অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখার উপায়-কৌশল। আর এখানেই আসে পাসফ্রেজের প্রাসঙ্গিকতা।

পাসফ্রেজ কী?

পাসফ্রেজকে পাসওয়ার্ডেরই উন্নত আরেকটি সংস্করণ বলা যেতে পারে। পাসওয়ার্ড সাধারণত হয় একটি বা দুইটি শব্দ জোড়া দিয়ে। সেখানে আপনি সংখ্যা, সংকেত, ছোট-বড় হাতের অক্ষরের সমন্বয়ে পাসওয়ার্ড তৈরি করেন। পাসওয়ার্ডে অক্ষর সংখ্যা যত বেশি হবে, সংখ্যা-সংকেতের বৈচিত্র্য যত বেশি থাকবে— পাসওয়ার্ডটি তত শক্তিশালী হবে। কিন্তু এটি যত জটিল হবে, তা মনে রাখাও তত দুরুহ হয়ে উঠবে। ধরা যাক, আপনি পরিচিত কোনো শব্দ ছাড়াই এলোমেলোভাবে একটি পাসওয়ার্ড ঠিক করলেন সেটি শক্তিশালী করার জন্য। “JmtY6!ve08&yU“। এটি শক্তিশালী হবে ঠিকই, কিন্তু মনে রাখা হবে খুবই কষ্টকর।

অন্যদিকে একটি পাসফ্রেজ তৈরি হয় কয়েকটি শব্দ দিয়ে। সেখানে অক্ষরের সংখ্যা ২৫ বা ৩০ থেকে ৫০… এমনকি ১০০ পর্যন্তও হতে পারে। এটি অনেক বড় মনে হলেও, সেখানকার শব্দগুলো আপনি সহজেই মনে রাখতে পারবেন। যেমন আপনি যদি “Rain Playing Moth Hunter” – এমন এলোমেলো কয়েকটি শব্দ দিয়ে একটি পাসফ্রেজ তৈরি করেন— তাহলে তা ভেঙে ফেলা তুলনামূলক কঠিন হবে। একইসঙ্গে এটি মনে রাখাও সহজ। এভাবে কয়েকটি শব্দের সমন্বয়ে তৈরি পাসওয়ার্ডকে বলা হয় পাসফ্রেজ। শব্দগুলোর মাঝে আপনি স্পেস রাখতেও পারেন, নাও রাখতে পারেন।

কেন পাসফ্রেজ ব্যবহার করবেন

অনলাইন অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড ভেঙে ফেলার একটি প্রধান কৌশল “ব্রুট ফোর্স অ্যাটাক”। এখানে হ্যাকাররা শক্তিশালী সফটওয়্যারের মাধ্যমে একের পর এক পাসওয়ার্ড প্রয়োগ করতে থাকে, যতক্ষণ না সঠিক পাসওয়ার্ডটি পাওয়া যায়।

মানুষ সাধারণত পরিচিত যেসব শব্দ দিয়ে পাসওয়ার্ড তৈরি করে—সেগুলো এদিক-সেদিক করে, অক্ষরের জায়গায় চিহ্ন বা সংখ্যা বসিয়ে একের পর এক পাসওয়ার্ড অনুমান করে যেতে থাকে সফটওয়্যারগুলো। একটি হিসেব অনুযায়ী, সাধারণত ৮-১০ অক্ষরের একটি পাসওয়ার্ডে যদি ছোট হাতের অক্ষর, বড় হাতের অক্ষর, নম্বর, সংকেত— সব কিছুই থাকে; তাহলে ৮ অক্ষরের পাসওয়ার্ডটি ভেঙে ফেলা যাবে ৩৯ মিনিটে, ১০ অক্ষরের পাসওয়ার্ডটি ভেঙে ফেলা যাবে ৫ মাসের মধ্যে।

কিন্তু আপনি যদি শুধু ছোট হাতের অক্ষর ব্যবহার করে একটি পাসফ্রেজ তৈরি করেন, যেখানে মাত্র ১৪টি অক্ষর আছে—তাহলে সেটি ভেঙে ফেলতে সময় লাগবে ৫১ বছর। এবং এমন একটি পাসফ্রেজ আপনি সহজে মনেও রাখতে পারবেন। এখন ১৪টির জায়গায় আপনি যদি ২৫ বা ৩০ অক্ষরের একটি পাসফ্রেজ ব্যবহার করেন— তাহলে সেটি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। হ্যাকারদেরও সেটি ভেঙে ফেলতে আরও ঘাম ঝরাতে হবে।

এর সঙ্গে যদি আপনি সেই পাসফ্রেজে কিছু অক্ষর, সংকেত, সংখ্যার বৈচিত্র্য আনেন— তাহলে সেটি ভেঙে ফেলা হয়ে উঠবে আরও কষ্টকর। যেমন, আগের উদাহরণটিই যদি ব্যবহার করা হয়, তাহলে “Rain Playing Moth Hunter”-কে আপনি বদলে দিতে পারেন এভাবে: “Ra^n P1@ying M0th HunTer”। এতে পাসফ্রেজটি আরও বিশৃঙ্খল হবে, এবং সেটি অনুমান করাও কঠিন হয়ে পড়বে। এভাবে অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তা আরও বাড়াতে চাইলে ৫, ৬ বা ৭ শব্দের পাসফ্রেজও তৈরি করতে পারেন। যেটি সহজে মনেও রাখা যাবে আবার সহজে ভাঙাও যাবে না।

আরও যেখানে পাসফ্রেজ অপরিহার্য

শুধু অনলাইন অ্যাকাউন্ট সুরক্ষাই নয়, আরও একটি দিক দিয়ে পাসফ্রেজের ব্যবহার খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো গোপনীয় বা সংবেদনশীল নথিপত্র এনক্রিপ্ট করে সংরক্ষণ করা বা অন্য কোথাও শেয়ারের জন্য এনক্রিপ্ট করার ক্ষেত্রে। যেমন, বিখ্যাত হুইসেলব্লোয়ার এডওয়ার্ড স্নোডেন তাঁর বার্তাগুলো পাঠানোর সময় নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলেন যে সেগুলো সাত শব্দের একটি পাসফ্রেজ দিয়ে এনক্রিপ্ট করা আছে কিনা। এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অন্য কারো হাতে যেন না পড়ে যায়— তা নিশ্চিতের জন্য সেটি এনক্রিপ্ট করে রাখার ক্ষেত্রে পাসওয়ার্ডের চেয়ে পাসফ্রেজ অনেক বেশি কার্যকরী।

পাসফ্রেজ নির্ধারণে করণীয়

পাসফ্রেজ, এলোপাথারিভাবে বেছে নেওয়া কয়েকটি শব্দ হতে পারে; আপনার কাছে অর্থ বহন করে—এমন কোনো বাক্য হতে পারে; বা হতে পারে কোনো উক্তি বা গানের লাইন। এমন কিছু শব্দ-সমাহার যা আপনি সহজে মনে রাখতে পারবেন। অনলাইনে পাসফ্রেজ বেছে নেওয়ার কিছু টুলও আছে। যেখানে এলোমেলোভাবে কয়েকটি শব্দ তুলে দেওয়া হয়। তবে কম্পিউটারের বাছাই করে দেওয়া পাসফ্রেজের তুলনায় নিজে নিজেই কিছু একটা ভেবে বের করা আদর্শ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সেটি হয়তো এমন একটি বাক্য হতে পারে যার মর্মার্থ শুধু আপনিই ‍বুঝবেন। ফলে আপনার জন্য সেটি মনে রাখাও সহজ হবে। যেমন, “once wished to be a reptilian alien”। পরিচিত কোনো গান বা উক্তিকে নিজের মতো করে বদলে দিয়ে সেটিকেও ব্যবহার করতে পারেন পাসফ্রেজ হিসেবে।

তবে বিখ্যাত মানুষের উক্তি, পরিচিত গান বা বইয়ের উদ্ধৃতি হুবহু পাসফ্রেজ হিসেবে ব্যবহার না করাই শ্রেয়। কারণ হ্যাকাররা যখন এসব পাসফ্রেজ ভাঙার লড়াইয়ে নামবে তখন তাদের প্রথম দিকের লক্ষ্যবস্তু থাকবে এসব জনপ্রিয় বই, গান বা উদ্ধৃতি।

আপনি যদি পাসফ্রেজ নির্ধারণের ক্ষেত্রে চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে চান, তাহলে ব্যবহার করতে পারেন ডাইসওয়্যার। এখানে লুডুর মতো ডাইস চালিয়ে শব্দ নির্ধারণ করা হয়। এভাবে সনাক্ত করা ৪ বা ৫ শব্দের পাসফ্রেজটি হবে বেশ বিশৃঙ্খল। ফলে বেশি শক্তিশালী।

শেষ কথা

পাসওয়ার্ড বা পাসফ্রেজ; যা-ই হোক না কেন; অনলাইনে অ্যাকাউন্ট সুরক্ষার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় থাকবে অপরিবর্তনীয়। যেমন, প্রতিটি অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড বা পাসফ্রেজ ব্যবহার করতে হবে। যেন কোনো এক জায়গার ডেটা হ্যাকিংয়ের কবলে পড়লেও অন্য অ্যাকাউন্টগুলো সুরক্ষিত থাকে। অনেকগুলো অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবহার করতে পারেন পাসওয়ার্ড ম্যানেজার। পড়ুন পাসওয়ার্ড ম্যানেজার কেন ব্যবহার করবেন?

আদর্শ পরিস্থিতি হতে পারে এমন: আপনি পাসওয়ার্ড ম্যানেজার দিয়ে আপনার সব অনলাইন অ্যাকাউন্ট সুরক্ষিত রাখছেন এবং পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের মাস্টার পাসওয়ার্ডটির জন্য বেছে নিচ্ছেন একটি শক্তিশালী পাসফ্রেজ, যেটির অর্থ শুধু আপনার কাছেই বোধগম্য হবে। এবং পাসফ্রেজটির কয়েকটি অক্ষর, সংখ্যা বা সংকেত দিয়ে বদলে দিলে সেটি হয়ে উঠবে আরও শক্তিশালী।