ইন্টারনেটের শুরুর দিনগুলোতে হয়তো হাতে গোনা কয়েকটি অ্যাকাউন্টের তথ্য মনে রাখাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এখন বিভিন্ন প্রয়োজনে আপনাকে অনেক ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এবং সেসব অ্যাকাউন্টের জন্য একটি পাসওয়ার্ড দিতে হয়। মনে রাখার সুবিধার্থে অনেকেই একই পাসওয়ার্ড বারবার ব্যবহার করেন বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের জন্য। কিন্তু এটি মোটেও নিরাপদ নয়। একটি পাসওয়ার্ড চুরি গেলেই সব একাউন্ট হাতছাড়া! তাই অনেকে ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড দেন। এটিই নিরাপদ অভ্যাস। কিন্তু তারা আবার সেগুলো মনে রাখতে গিয়ে হিমশিম খান। বেশ কিছু দিন পর কোনো অ্যাকাউন্টে ঢুকতে গিয়ে হয়তো দেখেন, সেটির পাসওয়ার্ড মনে নেই।

ঝামেলা এড়াতে, এবং সহজে মনে রাখার জন্য অনেকেই এমন সহজ পাসওয়ার্ড বেছে নেন, যা অনায়াসে ভেঙে ফেলা যায়। ফের তৈরি হয় নিরাপত্তা জটিলতা। তার সঙ্গে সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্য অন্যের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি তো রয়েছেই। তাহলে, অনলাইনে আপনার সব অ্যাকাউন্টের জন্য পাসওয়ার্ড ব্যবস্থা শক্তিশালী করবেন কীভাবে? এমন একটা ব্যবস্থা, যেখানে আপনাকে ডজন ডজন পাসওয়ার্ড মনে রাখেতে হবে না, আবার অ্যাকাউন্টটিও সুরক্ষিত থাকবে? উত্তর: পাসওয়ার্ড ম্যানেজার।

পাসওয়ার্ড ম্যানেজার কী?

এটি একটি অ্যাপ্লিকেশন বা সফটওয়্যার, যা আপনার সব অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড তৈরি করে এবং সেটি মনে রাখে। আপনাকে শুধু পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে ঢোকার জন্য একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ড (মাস্টার পাসওয়ার্ড) বেছে নিতে হবে এবং শুধু সেটিই মনে রাখতে হবে। এরপর আপনার ১০ বা ১০০; যত অ্যাকাউন্টই থাকুক না কেন; সেগুলোর প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা শক্তিশালী পাসওয়ার্ডটি বেছে নেবে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার। আপনাকে আর সেগুলো মনেও রাখতে হবে না। আবার শক্তিশালী পাসওয়ার্ডের কারণে আপনার অ্যাকাউন্টটিও সুরক্ষিত থাকবে।

কেন এটি নিরাপদ

প্রশ্ন জাগতেই পারে যে: একটি জায়গাতেই সব পাসওয়ার্ড জমা থাকলে, সেখান থেকেও তো এসব তথ্য অন্য কেউ হাতিয়ে নিতে পারে। কিভাবে নিশ্চিত হবো যে: সেখানে পাসওয়ার্ডগুলি সুরক্ষিত থাকবে?

ভালো একটি পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে তিন স্তরের নিরাপত্তা থাকে। প্রথমেই: ব্যবহারকারী তাঁর সব ডেটা এনক্রিপ্ট করে রাখেন। ফলে এখানে থাকা পাসওয়ার্ডগুলো সফটওয়্যারের মেমোরিতে জমা থাকলেও তা সেই কোম্পানির কোনো ব্যক্তি দেখতে পারে না। দ্বিতীয়ত: ব্যবহারকারীর মূল মাস্টার পাসওয়ার্ডটি সাধারণত পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের মেমোরিতে জমা রাখা হয় না। এবং এর সঙ্গে রয়েছে টু-ফ্যাক্টর-অথেনটিকেশন বা সিকিউরিটি কী। আপনার পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে জমা থাকা তথ্যগুলোর দিকে নজর দিতে গেলে যে কোনো হ্যাকারকে এই তিন স্তরের নিরাপত্তা ভাঙতে হবে, যা বেশ দুরুহ কাজ। এবং এটি আপনার তথ্যগুলো কোনো থার্ড পার্টি কোম্পানি বা ওয়েবসাইটের কাছে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও অনেক কমিয়ে দেয়।

এটি কিভাবে কাজ করে?

পাসওয়ার্ড ম্যানেজার প্রতিটি ওয়েবসাইট অ্যাকাউন্টের জন্য একটি নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড নিজে থেকেই নির্ধারণ করে। বড় হাতের অক্ষর, প্রতীক, সংখ্যা ইত্যাদির সমন্বয়ে তৈরি করা এই পাসওয়ার্ডটি হয় শক্তিশালী। যখন আপনি কোনো ওয়েবসাইটে, ধরা যাক অ্যামাজনে লগইন করতে যাবেন, তখন পাসওয়ার্ড ম্যানেজার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই ওয়েবসাইটের জন্য সংরক্ষণ করে রাখা শক্তিশালী পাসওয়ার্ডটি সেখানে ফিলআপ করে দেবে। আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। এতে করে আপনি অন্য কোনো ফিশিং ওয়েবসাইটে লগইন তথ্য দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে পারবেন। কারণ পাসওয়ার্ড ম্যানেজার শুধু amazon.com—এই ডোমেইনের জন্যই সেই নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ডটি ফিলআপ করবে। ধরা যাক আপনি ‍account-amazon.com—  এই অ্যাকাউন্টে লগইন করতে চাইলেন। কিন্তু এখানে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার সেই পাসওয়ার্ডটি ফিলআপ করবে না। কারণ এটি সত্যিকারের অ্যামাজনের সাইট নয়।

পাসওয়ার্ড ম্যানেজার সব ধরনের ডিভাইস, ব্রাউজার ও অপারেটিং সিস্টেমে কাজ করে। এবং আপনি আপনার ডিভাইসগুলোর সঙ্গে এটির সমন্বয়ও করে নিতে পারবেন। আপনার যে কোনো অ্যাকাউন্টে অন্য কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে এটি আপনাকে সতর্ক করবে, এবং আপনি দ্রুত সেই অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডটি বদলে ফেলতে পারবেন। বাড়তি নিরাপত্তার স্বার্থে আপনি সব অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডই কিছু সময় পর পর বদলে নিতে পারবেন। সেগুলো কখনোই মনে রাখার কথা আপনার মাথায় নিতে হবে না। শুধু পাসওয়ার্ডই নয়, কিছু পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে আপনি অল্প কিছু সংবেদনশীল তথ্য-ডেটাও এনক্রিপ্ট করে রাখতে পারবেন।

কোন পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করবেন?

অনলাইনে এখন অনেক পাসওয়ার্ড ম্যানেজার পাওয়া যায়। তবে ভালো সেবা ও মানের জন্য যাদের কথা বারবার উঠে আসে, সেগুলোর মধ্যে আছে: ওয়ান পাসওয়ার্ড, লাস্টপাস, ড্যাশলেন, কিপাস (ওপেন সোর্স)। কিছু ফিচারের দিক থেকে হয়তো তাদের মধ্যে খানিক ভিন্নতা পাওয়া যাবে। কিন্তু সবারই কাজের পদ্ধতি প্রায় একই ধরনের। এবং সবগুলোই ব্যবহার করা যায় বিনামূল্যে। অর্থের বিনিময়ে আরও কিছু বাড়তি সুবিধা নেওয়ারও সুযোগ আছে।

ওয়ান পাসওয়ার্ড-এ আরেকটি বিশেষ ফিচার আছে ভ্রমণ সংক্রান্ত পরিস্থিতি নিয়ে। এটির ট্রাভেল মোড ফিচারের মাধ্যমে আপনি কোথাও ভ্রমণের সময় আপনার অ্যাকাউন্টটি নিস্ক্রিয় করে রাখতে পারবেন এবং নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর আবার সেটি সচল করতে পারবেন। এতে যাত্রাপথে কোনো ডেটা চুরি যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। ওয়ান পাসওয়ার্ডের একটি বিশেষ সেবা আছে সাংবাদিকদের জন্য। এখানে নিবন্ধনের মাধ্যমে সাংবাদিকরা এই সফটওয়্যারটি ব্যবহার করতে পারেন বিনামূল্যে।

মাস্টার পাসওয়ার্ড নিয়ে সতর্ক থাকুন

পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করলে আপনাকে অন্য কোনো শক্তিশালী পাসওয়ার্ডই আর মনে রাখতে হবে না। তবে এই ম্যানেজারে ঢোকার জন্য আপনি যে মাস্টার পাসওয়ার্ডটি নির্ধারণ করে দেবেন — সেটি আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে। মাস্টার পাসওয়ার্ড ভুলে গেলে, আপনার পাসওয়ার্ড স্টোর চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এবং আপনি অন্য সব অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড হারিয়ে ফেলতে পারেন।

একই সঙ্গে এই মাস্টার পাসওয়ার্ডটি হতে হবে শক্তিশালী, যেন তা সহজে ভাঙা না যায়। এবং এই পাসওয়ার্ডটি কোথাও লিখে না রেখে মনে রাখুন। এতে এটি অন্য কারও হাতে পড়ার আশঙ্কা থাকবে না। কিভাবে এমন শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করতে পারেন, যা সহজে মনেও রাখতে পারবেন, তা জানতে পড়ুন: ডিজিটাল নিরাপত্তার প্রথম শর্ত শক্তিশালী পাসওয়ার্ড। আপনার পাসওয়ার্ড নিরাপদ তো?

অনলাইনে কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থাই শতভাগ সফল হবে- এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। তবে সেই আশঙ্কা কমিয়ে আনা যায় পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের মতো টুল ব্যবহারের মাধ্যমে। কারণ একেকটি অ্যাকাউন্টের জন্য একের পর এক নতুন পাসওয়ার্ড তৈরিতে সময় নষ্ট করার চেয়ে, একটি নিরাপদ সিন্দুকে (পাসওয়ার্ড ম্যানেজার) সব পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করাই লাভজনক। ঠিক যেমনটি বাড়ির দামী জিনিসপত্র নিরাপদের রাখার জন্য আমরা করে থাকি। তাই আপনার ঘরের মতোই, ভার্চুয়াল জগতের নিরাপত্তা নিয়েও ভাবনা শুরু করুন। 

আর আপনি যদি এ সম্পর্কে আরো জানতে চান, তাহলে নিচের রিসোর্সগুলো পড়ে নিতে পারেন।